আরফানুল জান্নাত
কিশোরগঞ্জ জেলা সদর ও ভৈরব উপজেলার মাঝামাঝি স্থানে অবস্থিত হচ্ছে কটিয়াদী উপজেলা ।পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পর তৎকালীন শাসকগোষ্ঠী ২৩ বছর ধরে বাঙ্গালীদের ওপর যে শোষণ নির্যাতন চালিয়েছে তার বিরুদ্ধে সারাদেশের মতো কটিয়াদীর মানুষের মনের তীব্র ক্ষোভের সৃষ্টি হয়। পাকিস্তানি বাহিনী কাউকে সামনে পেলেই দালালদের সহযোগিতায় ধরে নিয়ে আসতো। সেরকম একটি ঘটনা ঘটেছিল বাগ রাইট ও চারিপাড়া গ্রামে। এ গ্রামগুলো থেকে আটক হওয়া ১৮ জন নিরীহ গ্রামবাসীর মধ্যে ৭ জন কটিয়াদী উপজেলা সদরে পাকবাহিনীর বুলেটে নিহত হয়। এ রকম একটি ঘটনার সাক্ষী ছিলেন আলী আহম্মদ চান্দু।তিনি কটিয়াদী উপজেলার বাগরাইট গ্রামের ডাক্তার হিসেবে সুপরিচিত । তিনি মুক্তিযুদ্ধ না করেও দীর্ঘদিন মুক্তিযোদ্ধাদের স্মৃতি বহন করে চলেছিল। উনি যে ঘটনাটির কথা বলেছিলেন সেটি ঘটেছিল, কটিয়াদী থানা সংলগ্ন বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়ের নিকটবর্তী আড়িয়াল খাঁ নদীর পাড়ে। জুলাই মাসের মাঝামাঝি সময়ে দিনটি ছিল শনিবার বেলা ১২ টা থেকে ১টা। ঘটনার দিন চান্দু মহোদয়ের সাথে যে সাতজন ছিল তারা সকলে গণহত্যায় শহীদ হন ।হঠাৎ যখন তারা শুনতে পায় রাজাকারদের সহায়তায় পাকিস্তানি আর্মিরা আসছে হিন্দু পাড়া ঘেরাও করতে। এ কথা শুনে উনার সাথে থাকার সাতজন (আব্দুল মোতালিব, আব্দুল খালেক, আসির উদ্দিন খলিফা, আফাজউদ্দিন ,লাল মিয়া , লালু মিয়া ,মেঘলাল সাহা) দৌড় দিলে আর্মিরা ব্রাশফায়ার করে আর চান্দু পাশে থাকা পুকুরে লাফ দিয়ে কচুরিপানার নিচে পালিয়ে ছিল। তারপর উনি ওখান থেকে নরসিংদীর দিকে চলে যান ।ঘটনার দুদিন পর ওই স্থানে গিয়ে দেখে লাশগুলো শিয়াল-কুকুর খেয়ে বিচ্ছিন্ন করে ফেলেছে ।তখনকার কটিয়াদী উপজেলা চেয়ারম্যান আসাদ মিয়াকে এ ঘটনা জানালেন, যে বিচ্ছিন্ন কথাগুলো বাড়ি নিয়ে যাই। তিনি মাথাগুলো বাড়ি নিয়ে এসে বাড়ির পেছনে পুঁতে রাখে। তারপর দেশ স্বাধীন হলে এলাকার মানুষ বলে খুলি গুলো তুলে পুড়ে ফেলার জন্য কিন্তু উনার পরিচিত মানুষের এই সাতটি খুলি স্বাধীনতা স্মৃতিচিহ্ন হিসেবে রেখে দিয়েছিলেন। এইগুলো নিয়ে বিভিন্ন পত্রিকা ,টেলিভিশনে খবর প্রচারিত হলে অনেকেই এসেছিল খুলি গুলো নিয়ে সংরক্ষণ করার জন্য ।কিন্তু তিনি কাউকে দেননি। তারপর বাড়ি করার সময় ৭টি খুলি থেকে ৪টি ভেঙে যাওয়ায় তিনি মনস্থির করেন যে সরকারি কোন জাদুঘর এ সংরক্ষণের জন্য দিবেন ।অবশ্য অনেক কষ্ট করে উনার কাছ থেকে খুলিগুলো নেয়া হয়েছে ।যেহেতু আমি ইতিহাসের শিক্ষক তাই স্বাধীনতার স্মৃতিচিহ্ন সংরক্ষণের দায়িত্ব আমার উপরও বর্তায়। আমার ডিপার্টমেন্টের ছোট ভাই গণহত্যা- নির্যাতন ও মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক গবেষণা কেন্দ্রের গবেষণা কর্মকর্তা মোঃ আরিফ পারভেজ অনেক কষ্ট করে কিশোরগঞ্জ থেকে খুলনায় গণহত্যা জাদুঘরে নিয়ে এই খুলি গুলোর নতুন রূপ দিয়েছে ।আন্তরিক ধন্যবাদ জানাচ্ছি প্রখ্যাত ঐতিহাসিক অধ্যাপক মুনতাসীর মামুন স্যার ও আমার শিক্ষক চৌধুরী শহীদ কাদের স্যারকে ।উনাদের সহায়তায় এই ৩ টি মাথার খুলি মানুষের সামনে নতুনভাবে উপস্থাপিত হবে।
প্রভাষক (ইতিহাস )
তরণীরহাট ডিগ্রী কলেজ
গাবতলী ,বগুড়া।