মানবতার মূর্ত প্রতীক ছিলেন মাদার তেরেসা। বাংলাদেশের ইতিহাসে১৯৭১সালের মুক্তি সংগ্রামের পাশাপাশি আরোও একটি বিষয় যে গভীর রেখাপাত করেছিল সেটা হল একাত্তরের নারী নির্যাতন। পাকবাহিনীরা গ্রাম ও শহর থেকে ধরে নিয়ে যায় আড়াই লাখ বিভিন্ন বয়সী নারী । তারা নয় মাস এইসব মেয়েদের আটকে রাখে বিভিন্ন ক্যান্টনমেন্ট ও পাকসেনাদের ক্যাম্পে। তাদের উপর চলে শারীরিক ও মানুষিক নির্যাতন যা ইতিহাসে বিরল। দেশ স্বাধীন হবার পর নির্যাতিত নারীদের মধ্য থেকে প্রায় অনেক নারী অন্তঃসত্ত্বা হয়ে পড়ে। স্বাধীন হওয়ার আনন্দে যখন দেশের মানুষ তখন এই হতভাগা নারীদের অশ্রু জলে ভেসে আকুল হচ্ছে। পাক বাহিনী কর্তৃক নির্যাতনের পর এ অবৈধ সন্তানের ভবিষ্যৎ কি হবে? কে নেবে দায়িত্ব? বঙ্গবন্ধু এই নারীদের’বীরঙ্গনা মা” সম্বোধন করে সমাজের অনেক উঁচু তলায় স্থান দিলেও মানুষের মানসিকতার পরিবর্তন আসেনি। তাদের মধ্যে অনেকে লজ্জায় ঘৃণায় আত্মহত্যার পথ বেছে নেয় আবার অনেকে নিষিদ্ধ পল্লীতে আশ্রয় নেয়। এসময় মানবতাবাদী গবেষক ডাক্তার
ডেভিস লন্ডনে গিয়ে বলেন, বাংলাদেশে ধর্ষণের ফলে প্রায় দু’লাখ অন্তঃসত্ত্বার মধ্যে১,৭০০০০হাজার গর্ভপাত ঘটান।তারপরও যেসব বাচ্চার জন্ম হয়েছে তাদের আশ্রয় দেন তেরেসা হোমে। শিশুদের ভবিষ্যৎ চিন্তা করে তিনি তাদের মা-বাবার ও কাল্পনিক নাম দেন। ওই বছরই কানাডার স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন ‘ফ্যামেলিজ ফর চিল্ড্রেন’এর পক্ষ থেকে তিন সদস্য ঢাকায় আসেন এবং শিশুদের কানাডায় নিয়ে যাওয়ার প্রস্তাব করেন। কিন্তু কানাডায় এভাবে শিশু নেওয়ার আইন ছিল না। এর প্রতিবাদে মাদাম হ্যালকা ফ্যারি টরেন্টোর কুইনস্ পার্কে প্রাদেশিক পরিষদের সামনে একটানা ৩ দিন অনশন করলে সরকার এই শিশুদের নেওয়ার অনুমতি দেন। বাংলাদেশ সরকারও কানাডা সরকারের সহায়তায় ১৯৭২সালের জুলাই মাসে প্রায় ১৫ জন যুদ্ধশিশু টরন্টোয় পৌঁছায়। এই শিশুদের সন্তানহীন দম্পতিদের কাছে দত্তক দেওয়া হয়। আবার অনেকে সেসময় বলেছিল, এই শিশুদের খ্রিস্টান বানানোর জন্য কানাডায় নিয়ে যাওয়া হচ্ছে। মাদার তেরেসার ফ্যামিলিজ অফ চিল্ড্রেন “এ আশ্রয় দেয়া হয় ৫০,০০০ হাজার যুদ্ধশিশুকে।আর তৎকালীন দায়িত্বে নিয়োজিত মিসেস ক্যাপুচিনোর লিখিত প্রজেক্ট ফাইলে মাদার তেরেসা হোমের এর খাতায় এসব শিশু সম্পর্কে লেখা আছে -“War baby found in jungle”.তিনি হতভাগ্য শিশুদের সুন্দরভাবে বেঁচে থাকার জন্য যেমন চেষ্টা করেছেন তেমনি যুদ্ধবিধ্বস্ত দরিদ্র দেশে মারাত্মক জাতীয় সমস্যার হাত থেকে রক্ষা করেছেন । তিনি বিশ্বাস করতেন জন্ম যার যেভাবেই হোক না কেন জন্মের পরে সে একজন পূর্ণাঙ্গ মানুষ। তাকে বাঁচিয়ে রাখার দায়িত্ব মানুষেরই।এই মহীয়সী নারীর কাছে গোটা বাঙালি ঋণী।ঋণী সেইসব হতভাগ্য নির্যাতিত
বীরাঙ্গনারা যাদের জীবনের সংকটময় মুহূর্তে এই মাতৃরূপী মমতাময়ী নারী কাছে এসে দাঁড়িয়েছিলেন। বাংলাদেশ ও বাঙালি জাতি চির কৃতজ্ঞ তাঁর কাছে। আমার মতো অনেকেই হয়তো এই যুদ্ধ শিশুদের সম্পর্কে জানেন না। এই মহীয়সী নারীকে স্যালুট।
প্রভাষক (ইতিহাস)
তরণীরহাট ডিগ্রী কলেজ
গাবতলী, বগুড়া।