নিজস্ব প্রতিনিধি
শ্যামপুর গ্রামবাসী এবং এলাকাবাসী মিলে যাবতীয় আসবাবপত্র ও গুরুত্বপূর্ণ নথিপত্র লুট করাসহ শ্যামপুর দারুল উলুম দাখিল মাদরাসা ভেঙে শ্যামপুরে নিয়ে যাওয়ার অভিযোগ পাওয়া গেছে।
মাদরাসাটি কিশোরগঞ্জের মিঠামইন উপজেলা গোপদিঘী ইউনিয়নে অবস্থিত। এটি ধলাই গ্রামের হাওরে বা বন্দে অস্থায়ী অনুমতির বরাত দিয়ে পাঠদান কার্যক্রম চালানোর জন্য গত ৬ সেপ্টেম্বর অর্থাৎ সংঘটিত ঘটনার তিনদিন আগে নির্মাণ করা হয়েছিল।
এ নিয়ে মাদরাসার সুপার মো. আমিনুল হক বাদী হয়ে ৮২ জনকে আসামিসহ অজ্ঞাতনামা এলাকার আরও শতাধিক লোকের বিরুদ্ধে মিঠামইন থানায় মামলা দায়ের করেছেন। যার নং- ০৬, তারিখ ১০/০৯//২০২২ খ্রি.। ধারা- ১৪৩/৪৪৭/৩১৩/৪২৭/৫০৬/১১৪/৩৪ দ.বি.।
মামলা সূত্রে জানা যায়, পূর্বপ্রস্তুতিতে ঘটনার দিন পৌনে ৭টার সময় বিবাদীরা দেশীয় অস্ত্রসস্ত্রে সজ্জিত হয়ে মাদরাসায় ঢুকে ভাংচুর করে এবং ৩টি দোচালা ঘরের টিন, কাঠ, বেড়া, আসবাবপত্র ও গুরুত্বপূর্ণ নথিপত্রসহ আনুমানিক ২০ লাখ টাকার মালামাল লুট করে নিয়ে যায়। বিবাদীরা সেসব নিয়ে চলে যাওয়ার সময় ঘটনার বিষয়ে থানায় কোনো প্রকার মামলা করলে সাক্ষীদের জীবনের জন্য শেষ করে ফেলার হুমকি দেওয়া হয়।
মামলা সূত্রে আরও জানা যায়, ঘটনার স্থলে সাক্ষীরা উপস্থিত হয়ে ঘটনার কারণ জানতে চাইলে তাদেরকে এখানে মাদরাসার শিক্ষা কার্যক্রম চালাতে নিষেধ করে বিবাদীরা। তাছাড়া এ বিষয় নিয়ে বেশি বাড়াবাড়ি করলে শিক্ষক ও ছাত্রছাত্রীসহ অভিভাবকদের ক্ষতি হবে এবং মাদরাসার কার্যক্রম চিরদিনের জন্য বন্ধ করে দেওয়ার হুমকি দেয়। একপর্যায়ে বিবাদীরা মাদরাসার সুপারকে ফোলা জখম করে বলে অভিযোগ।
অনুসন্ধানে জানা যায়, সুপার মো. আমিনুল হক ধলাই-বগাদিয়া গ্রামে নতুন করে মাদরাসার প্রতিষ্ঠা করার জন্য পর্যাপ্ত জায়গা দেওয়ার মতো লোক না পেয়ে পাশের শ্যামপুর গ্রামে গিয়ে প্রতিনিয়ত ধরনা দেয়। এতে ক্ষুদ্র কৃষক মো. জজ মিয়া (বর্তমানে প্রয়াত) রাজি হয়ে ১০০ শতক জমি রেজিস্ট্রি দলিলে দান করে দেন। ফলে মাদরাসাটি ১৯৯৯ সালে শ্যামপুর গ্রামে প্রতিষ্ঠা লাভে সক্ষম হয়। সেই দানের জায়গার সুবাদে সুপারসহ ১৭/১৮ জন শিক্ষক-কর্মচারীর কর্মসংস্থান এবং স্থায়ী পাঠদানের অনুমতি ও বেতন-ভাতাদি হয়। এরপরেই ঘটে যত বিপত্তি।
২০১০ সালে এমপিওভুক্তির পর সুপার মো. আমিনুল হক পরিচালনা পরিষদের কাছে মাদরাসা আয়-ব্যয়ের হিসাব দিতে অসম্মতি জানালে বিরোধ দেখা দেয়। কিন্তু সুপার সেই হিসাব না দিয়ে এর পরিবর্তে পরিচালনা পরিষদ ও সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের অগোচরে রাতারাতি ২০১১ সালের পহেলা জানুয়ারিতে মাদরাসাটি সরিয়ে নিয়ে যায় নিজ এলাকা ধলাই-বগাদিয়া বাজারে। সেখানে স্বল্প পরিসরে ছোট দুটি দোচালা টিনশেড ঘর উঠিয়ে অফিসসহ দশটি শ্রেণির পাঠদান কার্যক্রম চালাতে থাকে কেবল কাগজে-কলমে, যা বিভিন্ন গণমাধ্যমেও প্রকাশ পায়।
সুপার শ্যামপুর গ্রাম থেকে মাদরাসাটি স্থানান্তরের এক বছর পর অর্থাৎ ২০১২ সালের জানুয়ারি মাসে বানোয়াট তথ্য উপস্থাপন করে উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার বরাবরে এক আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে পাঠদানের ক্ষেত্রে ‘অস্থায়ী অনুমতি’ নেয়। আর এটিকেই পুঁজি বানিয়ে মাদরাসাটি বারো বছরে ছয়বার জায়গা স্থানান্তর করা হলেও মাদরাসার সাবেক জায়গায় ফিরে যায়নি।
এমন পরিস্থিতিতে মাদরাসাটি স্থায়ী চত্বরে ফিরে পেতে একদফা দাবি জোরালো হয়ে ওঠে। ফলে প্রায় ১৪ শত ভোটারের ও আড়াই হাজার জনগোষ্ঠী অধ্যুষিত শ্যামপুর গ্রামে অনুষ্ঠিত ইউনিয়নবাসীর বিপুল উপস্থিতিতে ২০১৮ সালের জাতীয় সংসদ নির্বাচনী জনসভায় উপজেলার শীর্ষস্থানীয় নেতারা সেদিন মাদরাসার নিজস্ব স্থান শ্যামপুর গ্রামে ফিরিয়ে দেবার প্রতিশ্রুতি দেয়। কিন্তু পরবর্তীতে বারবার ধরনা দিয়েও কোনো প্রতিকার পায়নি।
অবশেষে ২০২০ সালের জুলাই মাসে শ্যামপুরবাসীর এক আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে ২০২১ সালের ১১ এপ্রিল প্রশাসনের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের সাথে নিয়ে এমপি রেজওয়ান আহাম্মদ তৌফিক সরেজমিন পরিদর্শন করেন এবং মাদরাসাটি সাবেক জায়গা শ্যামপুরে ফিরিয়ে আনার নির্দেশ দেন। যার মৌজা- মুশুরিয়া, খতিয়ান- ৬০, সাবেক দাগ- ৩৯৯ অর্থাৎ আরএস দাগ নং- ৮৭২ ও ৮৭৫।
তথাপি মাদরাসাটি পঞ্চমবারের মতো জায়গা পরিবর্তনে নতুন বগাদিয়া গ্রামের হারিছ বেপারির বসতভিটায় তোলা হলে গত ১২ জুলাই ঘূর্ণিঝড়ে বিধ্বস্ত হয়। এতে প্রায় দুই মাস শ্রেণি পাঠদান বন্ধ থাকে। এ নিয়ে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ও গণমাধ্যমে লেখালেখি শুরু হয়। ফলে তড়িঘড়ি করে গত ৬ সেপ্টেম্বর এমপি তৌফিকের নির্দেশ ও অবকাঠামোগত উন্নয়নের বহুমুখী পদক্ষেপকে উপেক্ষা করে ধলাই গ্রামের হাওরে বা বন্দে প্রধানমন্ত্রীর উপহার ত্রাণের ১১ বান্ডিল টিন দিয়ে ছোট দোচালা তিনটি ঘর উঠানো হলে শ্যামপুর গ্রামবাসী তা সাবেক জায়গায় তুলে নিয়ে আসে।
এ ব্যাপারে কথা হয় শ্যামপুর গ্রামের রেনু মিয়া (৬০), ফজলু মিয়া (৬০), সুন্দর আলী (৬০), বাচ্চু মিযা (৫২), মুজিবুর রহমান (৬০), আব্বাস আলী (৬৭), আজিজুল হক (৬২), সহর আলী (৬০), মাহতাব (৪৮), সোহরাব (৫০), রতন মিয়া (৫০), আলমগীর (৩০), জাহাঙ্গীর (২৬), মানিক (২৬) সহ শতাধিক লোকের সঙ্গে।
তারা জানান, সুপার ও তার সঙ্গীয়দের দ্বারা দীর্ঘ বারো বছর ধরে কুক্ষিগত করে রাখা শ্যামপুর মাদরাসা তারা পুনরুদ্ধার করে রাষ্ট্রপতিপুত্র এমপি রেজওয়ান আহাম্মদ তৌফিকের নির্দেশিত স্থায়ী ঠিকানায় অর্থাৎ শ্যামপুর গ্রামে এনে স্থাপন করেছেন।
তারা মাদরাসার ক্ষেত্রে দীর্ঘ বারো বছর ধরে ন্যায্য অধিকার থেকে বঞ্চিত থাকার কথা উল্লেখ করে জানান, সুপার যেসব কারণ দেখিয়ে প্রশাসনের অস্থায়ী অনুমতি ও আদালতের রায়ের দোহাই দিয়ে চলেছেন, আসলে সেসব কারণ এখন বাস্তবে বলবৎ নেই। এমপি রেজওয়ান আহাম্মদ তৌফিক গতবছর ১১ এপ্রিল প্রশাসনের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের নিয়ে জায়গা নির্ণয় করে উন্নয়নে শ্রেণি পাঠদান উপযোগী পরিবেশ তৈরি করে দিয়ে রেখেছেন। কিন্তু সাবেক জায়গায় মাদরাসা না থাকায় কোটি কোটি টাকার ভবন নির্মাণ কোনোটা ঝুলে আছে আবার কোনোটা ফেরত চলে গেছে।
এক্ষেত্রে শ্যামপুর ও এলাকাসী দায়েরকৃত মামলার যৌক্তিকতা নিয়ে প্রশ্ন তুলে তা প্রত্যাহার এবং মাদরাসা সুপারকে জবাবদিহিতার আওতায় এনে তার দুর্নীতি ও স্বেচ্ছাচারিতার তদন্ত ও বিচার দাবি করেন।
জমিদাতা ও সাবেক সভাপতি মো. জজ মিয়ার পুত্র শাহীন মিয়া (২৪) আক্ষেপ প্রকাশ করে বলেন, মাদরাসা স্থানান্তরের শোকে বাবা আমার মারা গেছেন।
একজনের দানের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান নিয়ে সুপারসহ অন্য কারো ছিনিমিনি খেলার অবসান চেয়ে পাঠদান ও প্রশাসনিক কার্যক্রম চালু করার জন্য শিক্ষার সাথে সংশ্লিষ্ট সবার সহযোগিতার আহ্বান জানান তিনি।
মিঠামইন থানার অফিসার ইনচার্জ (ওসি) কলিন্দ্র নাথ গোলদার বলেন, পুলিশ সুপার মোহাম্মদ রাসেল শেখ (পিপিএম বার) ও অষ্টগ্রাম সার্কেলের সহকারী পুলিশ সুপার সামুয়েল সাংমা ঘটনাস্থল পরিদর্শন করেছেন।
পুলিশ জনগণের জানমালের নিরাপত্তা কাজে সর্বদা নিয়োজিত রয়েছে উল্লেখ করে তিনি বলেন, সংশ্লিষ্ট এলাকায় আইনশৃঙ্খলা রক্ষায় পুলিশের কড়া নজরদারি রয়েছে। আর আসামিদের গ্রেফতারের প্রচেষ্টা অব্যাহত রয়েছে বলে জানান ওসি।