মো. আমানুল্লাহ:
শ্রম আদালতের মামলাসমূহ দ্রুত নিষ্পত্তিতে তথ্য প্রযুক্তি ব্যবহারের মাধ্যমে বিচারকার্য ত্বরান্বিত করতে, এবং ভুক্তভোগী শ্রমিকদের জন্য ন্যায়বিচার নিশ্চিত করতে বাধাগুলো চিহ্নিত করা ও তা দূরীকরণে উপায় অন্বেষনে বাংলাদেশ লিগ্যাল এইড এন্ড সার্ভিসেস ট্রাস্ট (ব্লাস্ট) ১৩ই মে, ২০২৪ তারিখ পিটস্টপ রেস্তোরা, লালখান বাজার, চট্টগ্রামে সংশ্লিষ্ট অংশীজনদের অংশগ্রহনে একটি কর্মশালার আয়োজন করে। এসময় শ্রম আদালতের মামলানিষ্পত্তিতে তথ্য প্রযুক্তির ব্যবহার বিষয়ে বক্তারা উল্লেখ করেন যে,
“দূরত্ব কোন বাধা নয়, আদালতে না গিয়েও শ্রমিকের পক্ষে অনলাইনে মামলার স্বাক্ষ্য দেয়া সম্ভব”
মূলত শ্রম আদালতে পরিচালিত মামলা সমূহের বাদী এবং সাক্ষীগণের বেশিরভাগই শ্রমিক হয়ে থাকেন। ফলে দেখা যায় যে, মামলার নির্ধারিত তারিখে শ্রমিকগণ তাদের কর্মস্থল থেকে ছুটি গ্রহণ করতে না পারার কারণে আদালতে অনুপস্থিত থাকেন। মামলার নির্ধারিত তারিখে তারা কর্মস্থলে না গিয়ে যদি আদালতে হাজিরা দিতে যান তবে তাদের উক্ত দিনের মজুরী কর্তন করা হয় এবং চাকরি হারানোর ঝুঁকি তৈরি হয়। অনেক ক্ষেত্রে চাকরি হারানো শ্রমিকগণ প্রত্যন্ত অঞ্চলে বসবাস করেন, ফলে মামলার তারিখে আদালতে উপস্থিত হওয়ার মতো আর্থিক সঙ্গতি বা সহজ যাতায়াত ব্যবস্থা লাভ করার মতো সক্ষমতা- কোনটাই থাকে না। এমতাবস্থায়, উপরোক্ত কর্মশালার আয়োজনের উদ্দেশ্য ছিল, শ্রম সংক্রান্ত মামলা নিষ্পত্তিতে আদালতে তথ্য প্রযুক্তির ব্যবহার উৎসাহিত করা; তথ্য প্রযুক্তির মাধ্যমে শ্রম আদালতে চলমান মামলাসমূহের জট কমিয়ে দ্রুত নিষ্পত্তির কৌশল নির্ধারণ করা; শ্রম আদালতের সকল বিচারপ্রার্থীদের তথ্য প্রযুক্তিতে অভিগম্যতা নিশ্চিতকরণের সহজ উপায় নির্ধারণ করা; শ্রম আদালতে সরকারী ও বেসরকারী আইনগত সহায়তা প্রদানকারী সংস্থার মাধ্যমে বিনামূল্যে আইন সহায়তা প্রাপ্তির প্রক্রিয়া আরও সহজীকরণ এবং সরকারী-বেসরকারী পর্যায়ে সমন্বয় সাধনে করণীয় নির্ধারণ করা নিয়ে কর্মশালাটি ব্লাস্ট আয়োজন করে।
কর্মশালার অতিথির বক্তব্যে চট্টগ্রাম ২য় শ্রম আদালতের চেয়ারম্যান এস এম জিললুর রহমান বলেন, জামিন শুনানী ও স্বাক্ষী প্রদানে তথ্য প্রযুক্তি ব্যবহার হচ্ছে। শ্রম আদালতেও আমার আদালত অ্যাপ-এ প্রতিদিন মামলার আপডেট দিতে হয়। শ্রমিকের মামলার বিচারকার্য পরিচালনার প্রধান বাধা হচ্ছে শ্রমিকের চাকরির প্রমাণপত্র না থাকা। কোন প্রকার নিয়োগপত্র ছাড়া শ্রমিক নিয়োগ করে শ্রমিককে তার আইনি অধিকার থেকে বঞ্চিত করা হয়। নারী শ্রমিকরা যৌন হয়রানির স্বীকার হওয়া সহ প্রসূতি কল্যাণ সুবিধা থেকে বঞ্চিত হয়ে থাকেন। তিনি বলেন, শ্রমিকদের মামলা পরিচালনায় তথ্য প্রযুক্তি ব্যবহারের ক্ষেত্রে তার স্মার্ট ফোন না থাকাটা কোন বাধা হবে না। আইনে বলা হয়েছে- সমন্বয়কারী থাকবে, এবং আদালত ঠিক করবে সমন্বয়কারী কে হবেন। আইনের এই বিধান ব্যবহার করা সম্ভব। এ বিষয়ে সচেতনতা বৃদ্ধি করতে হবে। এই সুবিধা সম্পর্কে শ্রমিকদের জানতে হবে। শারিরিক জখমের স্বীকার শ্রমিকের পক্ষে আদালতে আসা কষ্ঠকর। কর্মস্থলের ক্ষেত্রে প্রতিষ্ঠানের কোন কর্মকর্তা সমন্বয়কারী হতে পারেন। শ্রমিক কর্মস্থল থেকে ছুটি পায়না, তাই সাক্ষী পর্যায়ে মামলা নষ্ট হচ্ছে। শ্রমিককে আদালতের কাছে তার মামলা পরিচালনায় তথ্য প্রযুক্তি ব্যবহারের সুবিধা নিতে চাইতে হবে। তাহলে আদালত তাকে অনলাইনে স্বাক্ষ্য দেয়ার ব্যবস্থা করতে পারবে।
কর্মশালায় সভাপতির বক্তব্যে ব্লাস্ট চট্টগ্রাম ইউনিটের পরিচালনা পরিষদ সভাপতি অ্যাডভোকেট শ্রী সুভাষ চন্দ্র লালা বলেন, তৃতীয় পক্ষের দ্বারা শ্রমিক নিয়োগ করে কোম্পানী লাভবান হচ্ছে, আর শ্রমিক তার অধিকার থেকে বঞ্চিত হচ্ছে।
কর্মশালার প্যানেল আলোচক হিসেবে উপস্থিত ছিলেন চট্টগ্রাম জেলা আইনজীবী সমিতির সভাপতি ও ব্লাস্ট চট্টগ্রাম ইউনিট পরিচালনা পরিষদ সদস্য মোহাম্মদ নাজিম উদ্দিন, সাধারণ সম্পাদক ও ব্লাস্ট চট্টগ্রাম ইউনিট পরিচালনা পরিষদ সদস্য মো: আশরাফ হোসেন চৌধুরী রাজ্জাক, কলকারখানা ও প্রতিষ্ঠান পরিদর্শন অধিদপ্তর চট্টগ্রাম এর সহকারী মহাপরিদর্শক (সাধারণ) কুসুম আক্তার সোমা, জেলা লিগ্যাল এইড অফিসার (সিনিয়র সহকারি জজ) চট্টগ্রাম ইব্রাহীম খলিল, ট্রেড ইউনিয়ন কেন্দ্র চট্টগ্রাম এর সভাপতি এবং ব্লাস্ট চট্টগ্রাম ইউনিট উপদেষ্টা পরিষদ সদস্য তপন দত্ত।
প্যানেল আলোচনায় মোহাম্মদ নাজিম উদ্দিন বলেন, মামলা পরিচালনায় তথ্য প্রযুক্তি ব্যবহার করা যাদের প্রয়োজন সেই শ্রমিকের কাছেই প্রযুক্তি ব্যবহারের উপকরণ নেই। শ্রমিকেরা নিগৃহিত হয়ে প্রতিকারের জন্য শ্রম আদালতে আসে। ফলাফল বিলম্বিত হলে তারা আগ্রহ হারিয়ে ফেলে। কুসুম আক্তার সোমা বলেন, শ্রমিকেরা অনেক ক্ষেত্রেই ন্যায্য পাওনা পায়না, দূর্ঘটনায় পর্যাপ্ত ক্ষতিপূরণ পায়না, নারী শ্রমিকেরা যৌন হয়রানীর শিকার হয়। ডাইফ প্রতিষ্ঠানকে বাধ্য করতে পারেনা। আমাদের কাছে প্রতিকারের জন্য আসলে চেষ্টা করি বিকল্প বিরোধ নিষ্পত্তি পদ্ধতি ব্যবহার করে অল্প পরিমান পাওনার বিষয়গুলি দ্রুত নিষ্পত্তি করে দিতে। অপরপক্ষ সাড়া না দিলে সফল হওয়া যায়না। শ্রমিকেরা সাধারণত আদালতে যেতে পারেনা। অনেক ক্ষেত্রেই তারা তাদের প্রাপ্য পাওনা থেকে অনেক কম পেয়ে আদালতের বাইরে মিমাংসা করে ফেলে।
জনাব ইব্রাহীম খলিল বলেন- শ্রমিক আইন সহায়তা সেল চট্টগ্রামে কার্যকর না থাকলেও জেলা লিগ্যাল এইড অফিস থেকে শ্রমিকদের মামলায় আইন সহায়তা দেয়া হচ্ছে। পাওনা টাকার পরিমান কম হলে সাধারণত বিকল্প বিরোধ নিষ্পত্তি পদ্ধতি (এডিআর) ব্যবহার করে নিষ্পত্তি করা হয়। তথ্য প্রযুক্তি ব্যবহার করে সাক্ষ্য গ্রহন অনেক আইনজীবী আগ্রহী হয়না, কারণ ক্লায়েন্ট সরাসরি না আসলে আইনজীবী তার সম্মানী পান না। ডাইফ যদি ব্যর্থ হয়, যেন আমাদের সাথে যোগাযোগ করে। সচেতনতার অভাব রয়েছে ফলে আমরা সুবিধাগুলো নিতে পারিনা। তপন দত্ত বলেন, দেশে যখন কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা ব্যবহার বাড়ছে, তখনও শ্রমিকরা বাটন ফোনই ব্যবহার করছে। স্মার্ট ফোন ব্যবহারের সক্ষমতা না থাকায় শ্রমিকরা তথ্যপ্রযুক্তির সুবিধা থেকেও বঞ্চিত হচ্ছে।
ব্লাস্ট এর পরিচালক- আইন মো: বরকত আলী ও প্রোগ্রাম স্পেশালিষ্ট মো: তৈয়্যেবুর রহমান এর যৌথ সঞ্চালনায় সভার উদ্দেশ্য ও প্রেক্ষাপট তুলে ধরেন ব্লাস্ট এর অ্যাডভোকেসি এন্ড কমিউনিকেশন পরিচালক মাহবুবা আক্তার। তিনি বলেন- শ্রম সংক্রান্ত মামলা নিষ্পত্তিতে আদালতে তথ্য প্রযুক্তির ব্যবহার চর্চায় উৎসাহিত করা, তথ্য প্রযুক্তি ব্যবহারের মাধ্যমে শ্রম আদালতে চলমান মামলাসমূহের জট কমিয়ে দ্রুত নিষ্পত্তির মাধ্যমে ন্যায়বিচারে শ্রমিকদের অভগম্যতা বৃদ্ধি, শ্রম আদালতের সকল বিচারপ্রার্থীদের তথ্য প্রযুক্তিতে অভিগম্যতা তৈরিতে করণীয় নির্ধারন এই কর্মশালার উদ্দেশ্য। যাতে স্বশরীরে আদালতে উপস্থিত হওয়ার বাধাঁর কারণে শ্রমিকদের মামলা নষ্ট না হয় এবং তারা ন্যায় বিচার থেকে বঞ্চিত না হয়।
আদালতে তথ্য প্রযুক্তির ব্যবহার- শ্রম আদালত প্রেক্ষিত বিষয়ক মুল প্রবন্ধ উপস্থাপনা করেন ব্লাস্ট চট্টগ্রাম ইউনিট এর স্টাফ ল’ইয়ার অ্যাডভোকেট তাসনিয়া আল সুলতানা। করণীয় নির্ধারনে দিকনির্দেশনামূলক বক্তব্যে ব্লাস্টের পরিচালক (আইন) মো: বরকত আলী বলেন, সকল শ্রমিকের না থাকলেও ২০ থেকে ৫০ শতাংশ শ্রমিকের স্মার্ট ফোন আছে। সেগুলো ব্যবহার করেও অন্য সহকর্মী শ্রমিক উপকৃত হতে পারে। তিনি শ্রমিকের মামলা দ্রুত নিষ্পত্তিতে শ্রম আদালতে এডিআর পদ্ধতি ব্যবহার করা যেতে পারে বলেও মন্তব্য করেন।